মাল্টিমিডিয়া ৫০ হাজার ক্লাসরুম ॥ স্কুল কলেজ মাদ্রাসায়ঃ

মাল্টিমিডিয়া ৫০ হাজার ক্লাসরুম ॥ স্কুল কলেজ মাদ্রাসায়ঃ বিভাষ বাড়ৈ ॥

জাতীয় শিৰানীতি ও ভিশন ২০২১ বাস্তবায়ন আর ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে পাল্টে যাচ্ছে শিৰা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণী কৰের ধরন। শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) শিক্ষায় শিক্ষিত করা, শ্রেণী শিক্ষণ আকর্ষণীয় করা এবং শহর ও গ্রামের শিৰার বৈষম্য দূর করার লৰ্য সামনে রেখে নেয়া হয়েছে বিশাল উদ্যোগ। লক্ষ বাস্তবায়নে দেশের ৩১ হাজার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় সরবরাহ করা হচ্ছে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ এ সংক্রান্ত সকল শিক্ষা উপকরণ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণী শিক্ষণকে আধুনিক করার উদ্যোগের পর এবার বিদ্যুত আছে এমন ২০ হাজার ৫০০ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তৈরির প্রকল্পও চূড়ানত্ম। কেবল তাই নয়, বিদু্যতবিহীন ৭ হাজার ৪১৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসায় সোলার প্যানেল তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করা হবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী বছরের (২০১২) ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই ৩১ হাজার সরকারী-বেসরকারী শিৰা প্রতিষ্ঠানে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ এ সংক্রান্ত সকল শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করবে সরকার। ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শিৰা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিৰা অধিদফতর এবং প্রাথমিক ও গণশিৰা মন্ত্রণালয় পুরো প্রক্রিয়া বাসত্মবায়ন করতে হাতে নিয়েছে বেশ কয়েকটি প্রকল্প। ৪৬০ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাসত্মবায়িত হবে সরকারের নিজস্ব অথর্ায়নে। সরকারী ও বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসার মধ্যে যেগুলোতে বিদু্যত সংযোগ আছে সেগুলোতে আইসিটি শিৰা উপাদান সরবরাহ করা হবে।

অন্যদিকে প্রাথমিক ও গণশিৰা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতি উপজেলায় গড়ে কমপৰে ২০টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (যেগুলোতে বিদু্যত সংযোগ আছে) আইসিটি শিৰা উপকরণ সরবরাহ করা হবে। শিৰা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেয়া কাজে সরকারের ব্যয় হবে ৩০৬ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে 'ইনট্রুডাকশন অব আইসিটি এট সেকেন্ডারি এ্যান্ড হায়ার সেকেন্ডারি লেভেল'। সরকারের এ উদ্যোগের মধ্যে আছে শিৰকদের প্রশিৰণও। শিৰা প্রতিষ্ঠানে যারা এই বিষয়ে শিৰার্থীদের বোঝাবেন সেই শিৰকদের জন্য প্রকল্পে আছে প্রশিৰনের ব্যবস্থা। মাধ্যমিকের নবম ও দশম শ্রেণী ও উচ্চ মাধ্যমিক শিৰা সত্মরে বর্তমানে কম্পিউটার শিৰা ঐচ্ছিক (অপশনাল) বিষয় হিসেবে চালু আছে। আইসিটি প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি বিদ্যালয়ের কমপৰে একজন কম্পিউটার বিষয়ের শিৰককে দেয়া হবে প্রশিৰণ। দেশের ১০ হাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর এবং অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা হবে। জানা গেছে, এ বিষয়ে একটি ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রসত্মাবনা) প্রণয়ন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিৰা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাসত্মবায়নাধীন এই প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে 'আইসিটি স্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ইন প্রাইমারি স্কুল'। এই প্রকল্পে ব্যয় হবে ১৫০ কোটি টাকা। আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রাথমিক শিৰা সত্মরের এই প্রকল্প বাসত্মবায়ন করা হবে। আছে মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তথ্য প্রযুক্তি শিৰার সুযোগ। শিশু শিৰাথর্ীদের কাছে পাঠদান আরও আকর্ষণীয় ও প্রযুক্তির প্রতি শিশু শিৰাথর্ীদের আগ্রহ বৃদ্ধিতে দেশের ৫০৩টি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ১টি করে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিৰা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। চলতি বছরেই সবকটি মডেল বিদ্যালয়ে আইসিটি শিৰা উপকরণ পেঁৗছে যাবে বলে আশাবাদী প্রাথমিক শিৰার সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিৰা মন্ত্রণালয়ের সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় শিৰা প্রতিষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণের বিকল্প নেই। শিৰাথর্ীদের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সমর্্পকে দৰ করে গড়ে তুলতেই হবে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের সব মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১০ হাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া ও অন্যান্য শিৰা উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে। পযর্ায়ক্রমে বেসরকারী বিদ্যালয়েও এসব উপকরণ সরবরাহ করা হবে।


এদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণী শিৰণকে আধুনিক করার উদ্যোগই কেবল নয় একই সঙ্গে অত্যাধুনিক হচ্ছে সরকারী বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসার শ্রেণী কৰ। বিদু্যত আছে এমন ২০ হাজার ৫০০ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরম্নম তৈরির প্রকল্পও চূড়ানত্ম। কেবল তাই নয়, বিদু্যতবিহীন ৭ হাজার ৪১৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসায় সোলার প্যানেল স্থাপন করে প্রতিষ্ঠা করা হবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরম্নম। ২০ হাজার ৫০০ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরম্নম তৈরির প্রকল্পের জন্য নেয়া হয়েছে ৩২৫ কোটি টাকার প্রকল্প। ইতোমধ্যেই প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে একনেক। বিদু্যতবিহীন ৭ হাজার ৪১৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসায় সোলার প্যানেল স্থাপন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরম্নম প্রতিষ্ঠায় নেয়া হয়েছে ৬১০ কোটি টাকার প্রকল্প। এই প্রকল্পে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরম্নম তৈরির ব্যয় ছাড়াও প্রতিটি শিৰা প্রতিষ্ঠানে সোলার প্যানেল স্থাপনের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৬ লাখ টাকা। সরকারের এই প্রকল্পকে ব্যতিক্রম ও যুগানত্মকারী হিসেবে অভিহিত করেছেন সংশিস্নষ্ট সকলেই। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিৰা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নোমান উর রশীদ বলেছেন, শিৰানীতি ও ভিশন ২০২১ বাসত্মবায়নের আলোকে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির শিৰা সারাদেশে দ্রম্নত সম্প্রসারণ করতে হবে। প্রাথমিক থেকে শিৰার উচ্চতর সত্মর পর্যনত্ম কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি শিৰার ব্যবহার সম্প্রসারণ করতে হবে।

সেই লৰ্যেই সরকারের এই উদ্যোগ। তিনি বলেন, শিৰানীতিতেও যত দ্রম্নত সম্ভব শিৰার্থীদের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি শিৰা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, শিৰাথর্ীদের তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) শিৰায় শিৰিত করা, শ্রেণী শিৰণকে আকর্ষণীয় করা এবং শহর ও গ্রামের শিৰার বৈষম্য দূর হবে যুগানত্মকারী এই উদ্যোগের ফলে। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে আমাদের পুরো শিৰা ব্যবস্থার ওপর।
প্রাথমিক শিৰা অধিদফতরের মহাপরিচালক শ্যামল কানত্মি ঘোষ জনকণ্ঠকে বললেন, এই উদ্যোগের সুফল সম্পর্কে। তিনি বললেন, সব মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১০ হাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া ও অন্যান্য শিৰা উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিৰার্থীরা শ্রেণী কৰে একটি বিষয় শোনার সঙ্গে সঙ্গে প্রজেক্টরের মাধ্যমে দেখতে পারবে। এর ফলে শিৰা শিশুদের কাছে যেমন আকর্ষণীয় হবে তেমনি সহজে শিৰা আয়ত্তও করতে পারবে শিশুরা। এদিকে সরকারের এই উদ্যোগকে অভিনন্দন জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি করতে পরলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে আরেকধাপ এগিয়ে যাবে দেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে এটি হবে একটি মাইলফলক।

Monday, October 10, 2011

খোলা কলাম । জামায়াতের শক্তি প্রদর্শনী নিয়ে কিছু কথাঃ রাহাত খান


খোলা কলাম
জামায়াতের শক্তি প্রদর্শনী নিয়ে কিছু কথা
রাহাত খান

একটি ইংরেজি দৈনিক ২১ সেপ্টেম্বর তাদের প্রথম পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যে শোডাউন বা 'ক্ষমতা' প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল তার উদ্দেশ্য ছিল দুটো। এক. সরকারকে বুঝিয়ে দেওয়া যে তারা মোটেও কোনো দুর্বল প্রতিষ্ঠান নয়। দুই. তারা (জামায়াত) যে মিত্র দল হিসেবে মোটেও উপেক্ষণীয় দল নয়, তা প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে জানান দেওয়া। ১৯ সেপ্টেম্বর জামায়াতের প্রতিবাদ মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশের মধ্য দিয়ে দুটি উদ্দেশ্যই সাধিত হয়েছে। সমাবেশ ও মিছিল ঘিরে প্রথাগত কারণেই যে কোনো দল বা গোষ্ঠীর সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ ফোর্সের থাকার কথা, ছিলও তারা। তবে জামায়াতের অস্ত্র-সজ্জা ও চোরাগোপ্তা হামলার প্রস্তুতি সেদিন ছিল দেখার মতো। জামায়াত-শিবিরের একটা বড় অংশের কর্মীদের মাথায় ছিল হেলমেট, বহন করছিল তারা ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র এবং তাদের মুখ ছিল কালো কাপড়ে ঢাকা।

সেদিন পুলিশ নয়, অ্যাকশনে গিয়েছিল প্রথমে জামায়াত নেতা-কর্মীরাই। তারা ত্বরিত হামলা চালিয়ে পুলিশ বাহিনীর এসপি, এএসপি, ওসি থেকে শুরু করে বহু পুলিশ কর্মীর ওপরই গুলি ছুঁড়ে তাদের গুরুতরভাবে আহত করেছে। ৩৮ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও কর্মীর জখম গুরুতর। এছাড়াও শতাধিক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই জামায়াতের আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত কর্মীরা পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়। ১৯ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হওয়া একটি প্রতিবেদনের কিয়দংশ এখানে উল্লেখ করছি। প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম কলামে ইত্তেফাক লিখেছে : 'লাইফ বুলেট না থাকায় গত সোমবার রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে জামায়াতের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। জামায়াতের হামলা ঠেকাতে পুলিশের শট গানের ছররা গুলি ও টিয়ার শেল ব্যবহার করেও কোনো লাভ হয়নি। বরং বাতাসের বেগে বিপরীত (জামায়াতের তরফ থেকে) দিক থেকে ছুঁড়ে মারা টিয়ার শেলের দ্বারা পুলিশই আক্রান্ত হয়েছে। অন্যদিকে শট গানের ছররা গুলির লক্ষ্যভেদ সর্বোচ্চ ১৫ গজ হওয়ায় জামায়াতের চোরাগোপ্তা হামলায় (পুলিশ) বলতে গেলে পরাস্ত হয়। পরে অবশ্য পুলিশের একযোগে চেষ্টায় জামায়াতের হামলা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।

প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, পুলিশের ভাষায় লাইফ বুলেট মানে আত্মরক্ষার্থে 'স্পেশাল টাস্কফোর্স' পুলিশের কাছে দুটি করে চাইনিজ রাইফেল থাকা। বিরোধী রাজনৈতিক দলের হরতাল ও অন্যান্য প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আত্মরক্ষার্থে এই লাইফ বুলেট বা চাইনিজ রাইফেল দেওয়া হয়। তবে প্রতিরোধ করতে গিয়ে পাছে পুলিশের গুলিতে বিরোধী মিছিল বা সমাবেশে কোনো নিহতের ঘটনা ঘটে যায়, এই আশঙ্কায় সেদিন (১৯ সেপ্টেম্বর) পুলিশ ফোর্সকে ওই রাইফেল দেওয়া হয়নি।

পুলিশের কাছে চাইনিজ রাইফেল নেই, এ তথ্য খুব সম্ভব জামায়াত আগেই জানত। কীভাবে জানত তা সরকারেরই উচিত খুঁজে বের করা। দায়িত্ব তাদেরই। যা হোক, মুখোশ পরা হেলমেটধারী জামায়াত কর্মীরা পাকিস্তানি স্টাইলে অ্যাকশন শুরু করে এ সময়ই। আগ্নেয়াস্ত্র ছুঁড়ে বিপুলসংখ্যক পুলিশকে আহত করা ছাড়াও পুলিশের পাঁচটিসহ ১৩টি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর সংহত ও শক্তিশালী হয়ে পুলিশ পাল্টা আক্রমণে যায়। জামায়াতের চার নেতাসহ কয়েকশ কর্মীকে জামায়াতের সৃষ্টি করা 'রণাঙ্গন' থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত ১৯ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি স্থানে মিছিলের নামে জঙ্গি মহড়া এবং প্রতিবাদের নামে ভাঙচুর, গাড়ি পোড়ানো ও রক্তপাতের ভয়াবহ ঘটনা ঘটায়। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে অহিংস ও নিয়মতান্ত্রিক আচরণের প্রত্যাশাই থাকার কথা জামায়াতে ইসলামীর ওপর। তবে জামায়াতের কাছে জঙ্গি আচরণ ছাড়া রাজনীতিতে বেশি কিছু আশা করে না বাংলাদেশের জনগণ। কারণ দলটির নিকট ও দূর-অতীতই বলে দেয় জামায়াত কি এবং কোন প্রকার। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর নিজেদের স্তূপীকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ বহুবার পেয়েছে জামায়াত। কিন্তু তারা সেই সুযোগ কখনো নেয়নি। নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি। দলটি হচ্ছে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী। বাঙালি নিধনযজ্ঞের দোসর। বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় থাকা এ দলটি স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ হয়। একনায়ক জিয়াউর রহমানের আমলে পুনর্বার জীবন ফিরে পেয়েছিল তারা। তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত বর্বর ও পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের জন্য তারা কোনো দিন বাংলাদেশের জনগণের কাছে প্রকাশ্যে বা দলগতভাবে ক্ষমা পর্যন্ত চায়নি। অনুতপ্ত হওয়া তো দূরের কথা। এ যেন ১৯৭১ সালে বাঙালি নিধন ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য পাকিস্তান সরকারিভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়নি, কাজেই জামায়াতে ইসলামী কেন চাইবে?
বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর এই বৈশিষ্ট্য এবং অবস্থানের পেছনে দুটি কারণ নিহিত বলে অনেকে মনে করেন। এক. তারা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে ধর্মীয় দীক্ষা পেয়েছে ১৯৪৭-পূর্ব উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে সমালোচিত এবং প্রায় কোণঠাসা ধর্ম-গুরু ও রাজনীতিবিদ আবুল আলা মওদুদীর কাছ থেকে। আল্লাহর একত্ব এবং কোরআনের অলৌকিকতায় ঠিকই তিনি বিশ্বাসী। তবে আল্লাহ ও তার রাসূল যে ইসলামের ঈমান-আকিদার অঙ্গ, সেটা তিনি একটু দ্বিধা ও সন্দেহের চোখে দেখেন। তার ইসলাম সম্পর্কিত কতিপয় গ্রন্থে রাসূল (সা.) সম্পর্কে এই ধারণা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রমাণ মেলে। হাক্কানি আলেমদের মতে, মওদুদীর অনেক বক্তব্য ইসলামের ঈমান আকিদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাদের অনেকেই জামায়াতে ইসলামী এবং নেতা মওদুদীকে বিপথগামী বলে ভাবেন। জামায়াত ছাড়া সারা বিশ্বের মুসলমান সম্প্রদায় মওদুদীর ওই ধ্যান-ধারণাকে ইসলামের বিচ্যুতি এবং বেদাত বলে অভিহিত করেন। তাতে জামায়াতের যেন কিছু যায় আসে না। তারা রাজনীতি করে ধর্মকে ব্যবহার করে। সরল ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করাই জামায়াতের মিশন বা লক্ষ্য। এ জন্য কোনো তরিকারই মুসলিম সাধক, পণ্ডিত ও ইসলাম ব্যাখ্যাদাতারা জামায়াতে ইসলামীকে ইসলামী দল বলে মনে করেন না। না করুন। জামায়াত ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশে সব মুসলমানকে হিন্দু করে ফেলা হচ্ছে, মুসলমানদের রক্ষা করা দরকার, এই মিথ্যা কথাগুলো বলে বেশ কয়েকটি আরব দেশে কোটি কোটি দিনার-ডলার ভিক্ষা করেছে। লিবিয়াসহ কয়েকটি বাংলাদেশবিরোধী সন্ত্রাসী দেশের শাসককুলের কাছ থেকে চাঁদা তুলেছে। ভিক্ষা করা এবং চাঁদা তোলা এখন অনেকটাই কমে গেছে। কমে গেছে কারণ, যেসব দেশের শাসক ও মালদার আদমীরা জামায়াতকে ভিক্ষা ও চাঁদা দিত, তারা ইতোমধ্যে ভালোভাবেই জেনে গেছে বাংলাদেশে মুসলমানদের ধরে ধরে হিন্দু করার কথাটা একেবারে ভিত্তিহীন। এটা অর্থ উপার্জনে জামায়াতের মিথ্যাচার এবং শঠতা বৈ আর কিছু নয়। তারা এখন জামায়াতকে ভিক্ষা আর চাঁদা দেয় না। দিলেও তা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়।

তবে কাম যা করার তা বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী করে ফেলেছে। ভিক্ষা ও চাঁদালব্ধ টাকায় তারা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেদের ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানি, হাসপাতাল, ক্লিনিক, বাণিজ্যিক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত এ নিয়ে একটি গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার মতে, এসব প্রতিষ্ঠান থেকে জামায়াতে ইসলামী প্রতিবছর লভ্যাংশ হিসাবে পায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ তারা ব্যয় করে নতুন রুকন সংগ্রহ, গোপনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের অস্ত্র ক্রয়, বিদেশে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা, মিত্র রাজনৈতিক দলকে অর্থ সাহায্য ইত্যাদি খাতে। এসব কথা বা তথ্য কিছুই নতুন নয়। তারা যে রাজধানী শহরের চারপাশে মেস ও মাদ্রাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে প্রয়োজনে অফেনসিভে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এটাও বহু-কথিত একটি বিষয়।

বাংলাদেশ জামায়াতের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সংগঠনটি প্রচণ্ড ভারত-বিরোধী। পাকিস্তানপন্থি বিধায় পাকিস্তান ভাঙার জন্য তারা দায়ী করে ভারতকে। এ ছাড়া সংগঠন হিসেবে জামায়াত হচ্ছে অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক। যদিও সনাতন হিন্দু ধর্মের মূল ভিত্তি হচ্ছে এক. নিরাকার ও অদ্বিতীয় ব্রহ্ম, তথাপি দলটি হিন্দুবিদ্বেষী। শুধু হিন্দুবিদ্বেষী নয়, তারা শিয়া-বিদ্বেষী, কাদিয়ানী বিদ্বেষী, আগা খানি বিদ্বেষী। ফ্যাসিস্টদের মতো তারা মুসলমানদের বিভিন্ন তরিকার মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধায়, নিজেরাও সেসব রক্তক্ষয়ী, ধর্ম ও মানবতাবিরোধী দাঙ্গায় অংশ নিয়ে থাকে। সন্দেহ নেই, রাজনীতির এই দীক্ষা তারা নিয়েছে পাকিস্তান আমলে উগ্রপন্থি, সন্ত্রাসবাদী পাকিস্তানি সমর কর্মকর্তা ও জঙ্গিবাদীদের কাছ থেকে।

সন্ত্রাসী সংগঠন হুজি, জেএমবি, হিজবুত তাহরির (বর্তমানে নিষিদ্ধ) এবং আরও কয়েকটি গোপন সন্ত্রাসী দল ও গোষ্ঠীর জন্মদাতা জামায়াত। জামায়াতের গোপন দুই নম্বরের রেজিস্টার খাতায় সন্ত্রাসীদের নাম-ধাম লেখা আছে ঠিকই। তবে কৌশলগত কারণে বলা হয়, এরা আগে জামায়াত করত, তবে এখন সংগঠন থেকে তারা বহিষ্কৃত। এটা যে নেহায়েতই একটা গা-বাঁচানো কৌশল, তা বুঝতে কারও বাকি থাকে না। গত ১৯ সেপ্টেম্বর জামায়াত আন্দোলন ও বিক্ষোভ মিছিলের নামে যে শক্তি প্রদর্শনী করেছে তা আওয়ামী লীগ, এমনকি বিএনপি ও দেশের সচেতন দেশবাসীর হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে এবং দেশের রাজনীতি ও উন্নয়ন ধারাকে অস্থিতিশীল করতেই জামায়াতের এই প্রাথমিক শক্তি প্রদর্শনী। তবে এসব করেও যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকানো যাবে না এই কারণে যে, দেশের বৃহত্তর অংশের মানুষ বিশেষ করে তরুণ ও যুবকরা এই বিচার চায়। নানা অজুহাতে বা চাপে বিচার বিলম্বিত হলে কিংবা না হলে এর মূল্য আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে দিতে হবে। আমরা মনে করি, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও সন্ত্রাস এক কথা নয়। জামায়াত বা অন্য দল এই সত্য যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করবে ততই মঙ্গল। বছরে হাজার কোটি টাকার আয় কোনো রাজনৈতিক দলের সত্যিকারের সম্পদ নয়। রাজনীতির জন্য সত্যিকারের সম্পদ হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিধিবিধান মেনে চলা। কোনো বৈধ সরকারকে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে হটানোর দিন বহু আগে চলে গেছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক।

No comments:

Post a Comment